Poem

এক.

এই নিন, আপনার জন্য এসেছে নতুন সানকি, চেন আর
চামড়া র বকলস। মানুষেরই চামড়া, দেখে নিন।একবার
দেখে কবি নেমে যান নাবাল জমিতে। কচি শসা লিপ্ত হয়ে
আছে লতার ভাষায়, ফিঙে উড়ে চলে যায় রৌদ্রের গহনে।
দূর মাঠে কুয়ো থেকে জল ওঠে, আল চিরে চলে যায় স্রোত,
অজাত বীজের কানে কথা বলে,এসো, এত রৌদ্র, হাওয়া
উঠে এস অঙ্কুরের টানে।
অনেক দূরে কোথাও ঝিঙের ঝুড়ির উপর ওল্টানো কবির
ফোন বেজে যায়। পছন্দ হয়েছে তো আপনার, সানকিটা?
দামী চেন। বকলস টার জন্য বসে থেকেছি, বুঝলেন, কবে
কেউ মরবে, তারপর, —-জটিল রহস্য প্লাবী হাওয়া আসে
আকাশের বুক থেকে, ডাকতে ডাকতে উড়ে যায় কাকের
গলায়—-

 

দুই.

স্নান করে উঠে মেলে দিলেন একমাত্র শাড়িটি, সুতো সরে
জ্যালজেলে, লজ্জা নিবারণে তার বাগ্মিতা অল্পই,
কুয়োতলায় ঘড়া মাজবেন , জল ভরবেন, ততক্ষণে রোদ
বাতাস পেয়ে শাড়ীটি ফুলে ফুলে উঠবে, আছড়ে পড়বে
কবির আদুড় গায়ে, বোঝা যাবেনা এ তার হাসি না
শোকোচ্ছ্বাস। শাড়ীর দোকান দিয়েছেন শ্রেষ্ঠী বনের রাস্তায়,
কোন ক্রেতা নেই তাও। যদি অন্য মনে ফিরে চান যার
পরণের কাপড় জীর্ণতর হয়ে যাচ্ছে রোজ। অনাবরণের
দিকে যে হেঁটে যাচ্ছে, তাকে ফিরে ডাকবে সুতো, রং,
তাঁতের শব্দ?

 

তিন.

কবি কে এ পাড়ায় কেউ চেনেনা। তিনশো গ্রাম আলু
কিনতে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় আদ্যোপান্ত। তারপর গুড়,
বার্লি আর সাবুর জন্য আর এক চোট অপেক্ষা। এই সব
সেদিনই ঠিক হয়ে গেছে যেদিন ধুলো পায়ে সভা থেকে চলে
এসেছিলেন। কবি থেকে সভাসদ হতে পারলে পাড়ার কুকুর
গুলো ডাকতোনা আধো অন্ধকারে। রেল লাইনে আগাছা
গজিয়ে গেছে, ঘাসের লম্বা শিস। অনেক দিন ট্রেন চলেনা।
সূর্যাস্ত কালে কবির দীর্ঘ ছায়া পড়ে ট্রেন লাইনে। তার ওপর
দিয়ে যেতে যেতে একলা ইঞ্জিন ভাবে, ছায়াই দু খণ্ড হবে।
এমানুষ কখনও লাইনে গলা দেবেনা। তার গান আকাশে
বাতাসে ঘোরে যেন রৌদ্রের আকিঞ্চন।

চার.

সারা বছর ধরে জলের প্রান্তে জমেছে দাম, গুল্ম, আগাছা।
কেউ আসেনি উপড়ে তুলতে। জল সরে গেছে গুল্মদের
জায়গা ছেড়ে দিয়ে। সকালের রাস্তায় শিমূলের আঁকা বাঁকা
ছায়া। জলের দিক থেকে বিড়ির গন্ধ। মাথায় ভিজে ঘাসের
বোঝা চাপিয়ে দুজন মানুষ ডাঙায় উঠে আসছে। তাদের
কোমরের কাপড় ভিজে। সারা গায়ে জল। আজ তারা গরম
ভাত খাবে অনেকদিন পর।কবি রান্না করতে বসেছেন পথের
ধারে। নুড়ির উনান। কালো হয়ে যাওয়া হাঁড়ি। পাটকাঠি।
শুধু ভাত কি দেবেন, তাই নিজের মাথার মণিটি ফেলে
দিয়েছেন, ভাত ফুটছে, সুগন্ধ আর রঙ ঠিকরে উঠছে
আকাশ পর্যন্ত।

 

পাঁঁচ.

আঁধার যামিনী, তুমি দোল দাও
খেলা দাও শীর্ণ মনটিকে

এত কালো চিন্তা তার

এত মৃত্যু ভয়

কাজ নিয়ে ভুলে থাকে জীবনের মানে

বেলা হয়ে গেল ঝরা ধান কুড়াতে কুড়াতে
বেলা গেল তেঁতুল কুটিতে কুটিতে
গো সখীএর পর জল আনতে গেলে
সূর্য লুকিয়ে থাকে জলের ভিতর আর উঠে পড়ে কলসে আমার
সারা রাত ঘরে রোদ
কোথায় লুকাই
রমণের কাল তবু নির্লজ্জা প্রেতিনী বলে বর
ও রাত আমার কাব্য তোমার গহন নীলে রয়ে গেল, কলমের
অধরে এলো না।

 

ছয়.

পিছনে মরীচিকা, সামনে ডুবন্ত সূর্য, উদ্গত চাঁদ
সারি সারি শূন্য কলসেতে জল নাই
স্ফটিকের মালা গেঁথে বসে আছি ভোর থেকে , বঁধু এলে
গলায় পরাব।আমার দুই পা নাচে লবণাক্ত জলে,
কেলাসিত লবণ কে শান্ত হও স্থির হও ঘুম যাও বলে।
দুপায়ে শুকিয়ে ওঠে বালু, লবণের স্বাদ, পিপাসার জল নাই
ঘরে। তৃষ্ণা কি কবিতা কোনও, বুকের ভিতরে রক্ত কে
শুকিয়ে দেয়, তারপর বর্শা হয়ে ধেয়ে যায় মরীচিকা লক্ষ্য
করে হলুদ বালিতে? কবিতা কি সোনার হরিণ? মৃত্যু কালে
সে কি আসে কবির শিয়রে? স্ফটিকের মালা কই, বলে?

 

সাত.

বৃষ্টি নয়।রাতে শিশির পড়েছে। মাটির বুকে জেগে উঠেছে
প্রাচীন আর্দ্রতা। কবি গেছেন মাঠ চষতে, সঙ্গে দুই বলদ,
হালের মুঠো ধরতে ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে হাত।অসময়ে
মরদের ইন্তেকাল, লোকে আহা বলে। কবি আজ কাল
আর কলম ধরতে পারেন না। ক্ষতবিক্ষত হাত। গান বলেন , না
লেখা গীতিকাব্য। আলের গাছে বসে থাকা পাখিরা গায়
অচেনা কাহিনী।

 

আট.

অরণ্যে আগুন জ্বালা মানা। অথচ নিষ্প্রদীপ রাত। রোমশ
ঋক্ষ এসে ঘরের দুয়ারে বসে থাকে। অন্ধকারে মিশে থাকে
হাতী। মানুষের তাড়া খেয়ে জঙ্গলে ফিরেছে। কবি বনদেবী।
কন্দমূল, ঝরা পাতা, ওষধি জোগাড় করে রেখেছেন
পাকশালা টিতে। শিশুর কান্না শুনে বাঘ বোঝে , খিদে।
বোঝেনা ফরিস্টার, মানুষের চামড়ার উর্দি তার।সামান্য
রেড়ীর তেল, পিতল প্রদীপ তুলে নিয়ে যায়। খোঁপায়
জোনাকি জ্বেলে শিশুটিকে স্তন দেন কবি, চাল গুঁড়ি বেটে
দেওয়ালে আঁকেন রাত্রির নতুন কবিতা।

 

নয়.

তোমরা যারা দণ্ডী কাটতে কাটতে ঘাট পর্যন্ত যাবে, মান
সম্মান দিয়ে আসবে জলে, যাও, জেনো, তোমাদের সঙ্গে
আমি নেই। তোমরা যারা উপোস করে দুধ ঢালবে কালো
পাথরের উপর, ক্ষুধার্ত শিশুদের শাপ লাগুক তোমাদের।
হাড়িকাঠে রক্ত না দেখলে যাদের মনের বাসনা উথলে
ওঠেনা, তাদের নিক জঙ্গলের বাঘ।বামুন আর সন্ন্যাসীদের
এঁটোর ওপর গড়িয়ে যারা ভাবো অসুখ সারবে, তারা সব
ঘাটের মড়া।আমি তোমাদের কেউ নই, আমার কবিতা
ধিক্কার দিক অনন্ত জীবন তোমাদের উন্মাদ
আরোগ্যবাসনাকে।

 

দশ.

ঘুমের ভিতর ঝরে পাতা

এই আমাদের বৃন্দগান।

এই গাথা কারুবাসনার

এই গান সমুদ্রলহরী

তুমি কবি নহ নারী নহ তুমি মাতা।

প্রাচীন প্রবৃদ্ধ দারু অশ্ম তুমি প্রস্তরকালীন ,
ভূত্বক তলিয়ে গেলে চাপা পড়া দ্রোহ , উঠে আসিয়াছ।

গোষ্ঠী নেই, তুমি ছিন্ন শাখা, স্বয়ংবাহিনী

বুক চিরে রক্ত দেখাবার দায় নেই, প্রেমিক যে জন জেনে
গেছে
তোমার মধ্যে তুমি শেষতম না লেখা কবিতা