ঊর্বারূকের বন্ধন মুক্তি
আশ্চর্য এক বিকেল আজ, যখন আকাশে আলো নেই আবার অন্ধকারও না। অবিশ্রাম বর্ষণ চলেছে আজ বহুদিন হল, কত দিন তার সংখ্যাও মনে নেই এখন। যদিও সারা দিন বৃষ্টি পড়ে, এবং বোঝা যায় না কখন থেমেছে, তবু বৃষ্টি পুনরায় আসার আগের মুহূর্তগুলি কেমন যেন নিশ্চুপ, থমথমে। এ আরবসাগর কূলের বর্ষা, বাংলার বর্ষাকালের মত নয়। এখানে মেঘ করে আসা, বজ্রবিদ্যুৎ কোন অনুষঙ্গ থাকে না। ঝিরিঝিরি টুপটাপ ইত্যাদি মৃদুতার কোনও অস্তিস্ত্ব নেই। বৃষ্টি পড়ে মুষল ধারে , কোনও মার্জনা, ভণিতা ছাড়াই। ঝেঁপে যখন সে আসে কোনও বিরতির পর, তখন বহুদূরে গাছেরা মাথা ঝাড়া দিয়ে ওঠে প্রত্যাশায়, হ্রদের উপর দিয়ে ধাবমান বৃষ্টির পদশব্দ শোনা যায়, তারপর হঠাৎই পাখিদের একটানা কান্নার মতন ডাক ভেসে আসে কার্নিশ থেকে, বারান্দার রেলিঙের উপর থেকে, বোঝা যায় ক্রমাগত ভিজে তাদের পালকে, ডানায় আর জল ধারণ ক্ষমতা নেই।
দুধিলতার কবি-সম্পাদক বহু দূর থেকে ডাক পাঠিয়েছেন লেখা চেয়ে, আমি লেখাটির চেয়ে অনেক বেশি করে লতার কথা ভাবছি, আর সেই সব মানুষের কথা যারা ঐ লতা দিয়ে বোঝা বেঁধে মাথায় তুলে নিয়ে যায়। এমন বর্ষায় সবুজ লতারা আরও ঘন সবুজ হয়ে উঠেছে, এখান থেকেই দেখতে পাই। লতা থেকে বন্ধন, বন্ধন থেকে মুক্তি। এই ভাবে আমার চিন্তা প্রবাহিত হয়। আমার মনে পড়ে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের সেই “ঊর্বারূকমিব বন্ধনান্মৃত্যোর্মুক্ষীয় মাঅমৃতাত্”। ঊর্বারূক এর অর্থ শসা। যে নিত্য দিনের সাধারণ ফলটি আমরা খাই, তাকে লতা থেকে তুলে নেওয়া ভারি সহজ। সে আবদ্ধ, আবার অলিপ্তও। মহামৃত্যুঞ্জয়ের মত মন্ত্রে প্রবেশ করেছে , এমন যোগ্যতা তার, সেই সবুজ সাদা ঈষৎ দীর্ঘ শসাকে আর তত সহজ ভাবে নিতে পারি না এর পর। আমার কি এমন হওয়ার কথা ছিল? মৃত্যুর বন্ধন থেকে অনায়াসে মুক্ত অর্থাৎ জীবনে প্রত্যর্পিত। অতএব নির্ভীক। সাধারণত মৃত্যুই তো ছিন্ন করে জীবনের বন্ধন থেকে। আলিঙ্গন রিক্ত করে, কোল খালি করে নিয়ে চলে যায়। জীবনও কি হতে পারে মৃত্যুর প্রতিদ্বন্দ্বী? নিয়ে যাওয়া নয়, ফিরিয়ে নেওয়া। ভয় থেকে মুক্ত করা।
আমি যেখানে বসে আছি, সে জায়গাটা বড় রাস্তার থেকে দূরে, ভিতরের দিকে। গাড়ি-ঘোড়ার শব্দ খুব প্রখর নয়। কিন্তু থেকে থেকেই নাড়া দিয়ে চলে যায় অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ। জ্যামে আগে আটকে থাকত এই সব জরুরি গাড়ি। এখন বুঝি কষ্টেসৃষ্টে পথ পাচ্ছে। দু-মাস আগেও শব্দ উঠত অনেক বার, দিনের মধ্যে, এখন কমে এসেছে। মানুষ মারা যাচ্ছিল অ্যাম্বুলেন্সের অপেক্ষায়, রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টের জন্য পথ চেয়ে, হাসপাতালের দরজায় ঘুরতে ঘুরতে, এমার্জেন্সির করিডরে, ট্রলিতে, হাসপাতালের বিছানাতেই অক্সিজেন না পেয়ে। এখন মৃত্যুর দৈনিক সংখ্যা কমে এসেছে। কমেনি মৃত্যুভয়। কে না জানে, যে রোগ ঢুকে এসেছে আমাদের সংসারে সমাজে, তা রইলই, সে যাবে না! গণপরিবহন বন্ধ, দোকান পাট খুলেছে, স্কুল-কলেজ এখন খোলা সম্ভব নয়, সংক্রমণ বেড়ে যাবে। এগুলি খুললে শহরে আবার দাবানলের মত ছড়াবে অসুখ। এখন সে গেছে গ্রামাঞ্চলে, যেখানে দু-মাস আগেও তার যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল না। সে পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে, বনের মধ্যে আগুন যেমন খোলা জায়গা না পেলে থামে না। তার পিঠে একটা বড় থলে, আড়াল আবডাল থেকে চকিতে বেরিয়ে সে নিয়ে চলে যায় বোঁটা থেকে শিথিল হয়ে আসা অথবা ঝরে পড়া একটি হলুদ পাতা। কখনও আবার পড়ে থাকা জিনিস কুড়োতে তার ভালো লাগে না। সে তাজা ফুলটি টেনে ছিঁড়ে নিজের ঝুলিতে ভরে। তাকে আমরা ভয় পাই। কারণ সে সংক্রমণ ছড়াতে পারে দ্রুত, এক থেকে বহুর মধ্যে, মারা যায় একশোর মধ্যে দু-জন। এর চেয়ে বেশি মৃত্যু হার অনেক অসুখের। কিন্তু কোন দুজন আমাদের মধ্যে হলুদ পাতার নির্দিষ্ট ভাগ্য নিয়ে বসে আছে তা জানি না, তাই আমরা পালাতে চাই। অন্যের চেয়ে দূরে, নিজের চেয়েও। আমার সহজাত স্নেহ মায়া করুণা সহমর্মিতার বোধ নির্মূল করে পালাতে চাই, দূরে, যাতে রোগের নখর আমাকে স্পর্শ না করে।
এ রোগ মানুষকে কেবল জীবনে মারছে না, হত্যা করছে জীবিতদের চিত্তবৃত্তিকেও। প্রতিবেশী অসুস্থ হলে মানুষ খবর নেবে এ আজ চিন্তার অতীত, যদি তাদের সপরিবারে নিগৃহীত করে বাড়ি ছাড়া না করে সেটাই তাদের মহত্ত্ব। ঔদাসীন্যের পরাকাষ্ঠা , নির্মমতার চূড়ান্ত উদাহরণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে সাধারণ, স্বাভাবিক, শিক্ষিত, অশিক্ষিত নির্বিশেষে। কারণ ? সংক্রমণের ভয়? তাহলে রাজনৈতিক জমায়েতে কোনও নিয়ম না মেনে, মুখবস্ত্রও না পরে, যারা দলে দলে ভিড় করছেন, তাঁদের ভয় নেই? ধর্মানুষ্ঠানে এই অকালেও যাঁদের ভক্তি অচলা, তাঁরা কি এলাকার ডিউটি ফেরত ডাক্তারবাবু কিংবা সিস্টার কে সামাজিক বয়কট করছেন না? কী হবে দেখা যাক, বলে যে সব বিজ্ঞ ব্যক্তিরা, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে চায়ের দোকানে বসে আছেন অথবা করোনা-প্রতিষেধক মিষ্টির দোকানে লাইন দিয়েছেন, তাঁদের কি নিজেদের জীবনের প্রতি ঔদাসীন্য মৃত্যুভয় থেকে মুক্তির দ্যোতক? ডাক্তারি নিষেধাজ্ঞা না মানার প্রবণতা বিদেশেও তরুণ-তরুণী এবং বয়স্কদের মধ্যে একই ভাবে বিদ্যমান। কারণ অন্যের স্বার্থে নিজের স্বাধীনতা খর্ব হতে দিতে তাঁরা নারাজ। কিন্তু বিদেশে সামাজিক নিগ্রহ বা অবরোধের ঘটনা তেমন কানে আসেনি। কারণ অবশ্যই ব্যক্তি- স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধাবশত তাঁদের ঔদাসীন্য কি নিগ্রহের চেয়ে প্রার্থনীয়, তা বলার মত অবস্থা এই কঠিন সময়ে আসেনি।
আরম্ভে এই কথাটা মনে এসেছিল— জীবন কি হতে পারে না মৃত্যুর চেয়ে নিশ্চিত, শক্তিশালী? মৃত্যুভয় থেকে আমাদের ঊর্বারূকের মত ছিন্ন করে সে কি পেতে দিতে পারে না কোল? লেখার মধ্যেই খবর এলো, এক প্রিয় বন্ধুর চলে যাওয়ার। পাটনার হাসপাতালে তার রোগের সঙ্গে লড়াই চলছিল। কোনও অন্য অসুস্থতার কথা জানতাম না, যাকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলে, কোমর্বিডিটি। তার দীর্ঘ সবল শরীর, উচ্চগ্রামের হাসি, এতকাল আমাদের আশ্বস্তই করেছে কেবল। চল্লিশ বছরের সেই আস্থা চুরমার করে দিয়ে সংক্রমণ যখন তাকে ঝরা একটি পাতার মতন কুড়িয়ে নিয়ে চলে গেল, মৃত্যুর প্রতি কোন ভয় বা সম্ভ্রম জাগলো না আমার। সেই মুহূর্তে মৃত্যুকে ঘৃণা করলাম আমি, আন্তরিক প্রত্যাখ্যান জানালাম তাকে। সে তো কেবল নিতেই জানে। যাদের নেয়, তাদের নিয়ে কী করে, তা আমাদের কাছে অন্ধকারে নিমজ্জিত। যে চলে গেল মৃত্যুর বাঁধনে বাঁধা পড়ে গেল, সে একা এবং একমাত্র সে। কিন্তু আমরা অমৃতে প্রত্যর্পিত হব কী ভাবে? আমরা জীবনের দিকে চোখ ফেরাই। আমরা দেখব, জীবিতগণ মৃতদের চেয়ে বেশি। আমরা তাদের শুশ্রুষা করি, আমরা তাদের জন্য একত্র করি আমাদের সংঘবদ্ধতার শক্তি। কত হাজার বছর আমরা সামাজিক জীবন যাপন করছি। আমরা গড়েছি নগর, রাজ্য, সংঘ, আশ্রম, পঞ্চায়েত, তিলে তিলে প্রয়োজন, সহানুভূতি, রাজনীতি, সব কিছুর সামর্থ্য মিলিয়ে মিশিয়ে।
একটি সংক্রমক অতিমারী কি আমাদের সভ্যতার ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে পারে? মৃত্যুভয় আমাদের এত সন্ত্রস্ত করে তুলল কীভাবে, যে আমরা জীবিতের মুখের দিকে তাকাতে ভুলে গেলাম? আমাদের ফুটপাথে পড়ে থাকা প্রৌঢ়, বাসস্থানচ্যুত নার্সদিদি, একঘরে ডাক্তার, তাদের প্রতি আমাদের স্বাভাবিক করুণা জাগে না, অথচ আমরা কেউ ফুটপাথে পড়ে থাকতে চাই না, আমরা সকলে হাসপাতালে সেবা চাই। আমরা বাঁচতে চাই কিন্তু সবাইকে নিয়ে বেঁচে থাকতে গেলে যে দায়িত্বশীল সামাজিক আচরণ প্রয়োজন, তা করতে রাজি নই। আমার জন্য এলাকায় সংক্রমণ যদি বেড়ে যায়? এই কথা ভেবে মসজিদ মন্দির মিছিলে যেতে নিরস্ত হই না আমি। কারণ আমি তো সর্বজ্ঞ, আমি দোষের অতীত। জীবনকে ভালোবাসলে আমি কি নিজেকেও কিছু ওলটপালট করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে পারি? বুঝতে পারি কোথায় আমার নাড়ীটান ক্ষয়ে গেছে? নিজেকে ভালোবাসার সংজ্ঞা বদলে যায়, যখন মৃত্যু খুব কাছে এসে দাঁড়ায়। এখন যা প্রার্থিত, তা শঙ্কা থেকে মুক্তি। তার জন্য নিজের থেকে চোখ সরিয়ে অন্য অপরাধীর সন্ধান, সে আর এক আত্মপ্রবঞ্চনা। না, এই দু:সময়ে নিজেকে প্রবঞ্চনা করে অমৃতের সন্ধান করা সম্ভব নয়।
রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর স্বরূপ নিজের কাছে উন্মোচিত দেখেছেন। তার ভয়ের ভাণের আড়ালে যে কিছু নেই, বিস্ময়কর, রহস্যময় তা তিনি সাহিত্য জীবনের আরম্ভেই বুঝেছিলেন। ২৯ শে জুলাই ১৯৪১ সালে লেখা শেষলেখার এই কবিতাতেও সেই দার্শনিক উপলব্ধি:
“দু:খের আঁধার রাত্রি বারে বারে
এসেছে আমার দ্বারে;
একমাত্র অস্ত্র তার দেখেছিনু
কষ্টের বিকৃত ভাণ,
ত্রাসের বিকট ভঙ্গি যত—
অন্ধকার ছলনার ভূমিকা তাহার।
যতবার ভয়ের মুখোস তার করেছি বিশ্বাস
ততবার হয়েছে অনর্থ পরাজয়।’’
কবি লিখেছেন, মৃত্যুর নিপুণ শিল্প বিকীর্ণ আঁধারে। অন্ধকারে নিমজ্জিত মৃত্যুর শিল্পের চেয়ে কবি অনেক বড় আশ্রয় পেয়েছিলেন, আলোকোজ্জ্বল জীবনে। আমরা কবির মতন সত্যদ্রষ্টা নই, আমাদের আত্মোপলব্ধির পথ পাথর ছড়ানো। তবু বুদ্ধিহীন শিশু যেমন মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে আসে, পিছনে মৃত্যুর ছায়া রেখে, আমরা কি তেমন ফিরতে পারি শঙ্কাহীন জীবনে? তার জন্য একটিই পথ, সম্মিলিত সংবেদনা। ভয়ের বন্ধন মুক্ত হতে গেলে যুক্ত হতে হবে পরস্পরে। ব্যক্তি মানুষের অনিশ্চয়তা, শঙ্কা যার ক্ষুধার অন্ন, সেই ধনতন্ত্র চালিত রাজনীতি কি পথ ছেড়ে দেবে? না দিলে তার সন্ত্রাসকে পরাস্ত করে এগোবার মন্ত্র কি আমরা জানি? তার জন্যও তো ফিরতে হবে কবির কাছেই।
“এ মাটি আমারই মাটি? একদিন দুহাত ভরে দিত? / আমি কি মেরেছি তাকে? নাকি আমিই সে মৃত? / যা হবার হবে—/ এসো আজ মিলে যাই এ মহান মিলনোৎসবে—/ অনুপ্রেরণায়। সগৌরবে। ”
ঋণ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শঙ্খ ঘোষ।